ঢাকা থিয়েটারের নতুন প্রযোজনা আউটসাইডার শুরুর আগে নাটকের নির্দেশক হিসেবে আলব্যের কামুকে নিয়ে তিনি বলছেন দু-চার কথা। ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় আমরা তখন ভাবছি, ঢাকা থিয়েটার হঠাৎ আউটসাইডার মঞ্চে আনল কেন?
ভাবনাকে শিঁকেয় তুলে রাখতে হলো—নাটক শুরু হয়ে গেছে।
পুরো মঞ্চ সাজানো হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির কয়েকটি লম্বা বাক্স দিয়ে, ওপর দিকেও ঝুলছে একটি বাক্স। নাটক দেখতে গিয়ে আমরা দেখলাম বাক্সের কেরামতি! বাক্স কখনো হয়ে উঠছে কফিন, কখনো সমুদ্রসৈকত; আবার যেন কোনো এক জাদুর মহিমায় সে হয়ে গেল ফ্ল্যাটবাড়ি কিংবা কারাগারের গরাদকক্ষ। মঞ্চ পরিকল্পক হিসেবে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পুরো মাত্রায় সফল। কিন্তু এ নাটকের নির্দেশক হিসেবে কতটা সফল তিনি?
আসুন, একঝটকায় নাটকটি দেখে নিই।
ম্যারসলের মায়ের মৃত্যু হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের শেষকৃত্যে সেখানে এসেছে ম্যারসল। এ সময় তার মনে উঁকি দিয়ে যায় বিগত জীবন—তরুণ বয়সে এক সুদর্শনাকে ভালোবেসেছিল সে। সেই সুদর্শনার জন্য মায়ের হূৎপিণ্ডও নিয়ে এসেছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান, এই হূৎপিণ্ড নিয়ে আসার গল্প তো হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের, এটা তো আউটসাইডার উপন্যাসে নেই।
বুঝলেন না, উপন্যাস থেকে নাটকে উপস্থাপিত হওয়ার কালে নানা কিছু গ্রহণ করেছে নাটকটি। যেমন মাতিস, গঁগা—এই বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্মগুলো নাটকের শরীরে মানিয়ে গেছে ভালোভাবেই।
মায়ের শেষকৃত্যের পর ম্যারসলকে এখন দেখতে পাচ্ছি, প্রেয়সী মারিকে নিয়ে ম্যারসল চলেছে সিনেমায়। এই তো প্রতিবেশী রেমন্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো তার। কাহিনির একপর্যায়ে খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হলো ম্যারসলের।
আলব্যের কামুর উপন্যাসে দেখা যায়, ম্যারসলের কাছে জগৎ উপস্থিত হয়েছে একরাশ অর্থহীনতার আবরণে। বন্ধু ও বন্ধুহীনতা—তার কাছে দুইয়েরই একই মানে, যেন কিছুতেই কিছু আর আসে যায় না। উপন্যাসের এসব বৃত্তান্ত নাটকেও আছে। তবে উপস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে হরেক রকম নাটকীয়তা।
কিন্তু আসল ঘটনা অন্যখানে। ওই যে লেখার শুরুতে প্রশ্ন এসেছিল, ঢাকা থিয়েটার হঠাৎ আউটসাইডার মঞ্চে আনল কেন? জবাব মিলল নাটকের শেষ পর্যায়ে।

ম্যারসলের মৃত্যুদণ্ডের পর কাহিনি তো শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু নাটক তখনো চলছে! নাটকের এ পর্যায়ে দেখানো হচ্ছে অদ্ভুত এক নগর, যেখানে সবকিছু চলে উল্টো নিয়মে। যেমন সবাই সোজা নয়, হাঁটে উল্টো করে, আবার কেউ যদি নাগরিক সংবর্ধনা পায়, বুঝতে হবে তার মৃত্যু আসন্ন। এই পরম্পরায় মঞ্চে এল এক কবি—সোজা হাঁটার অপরাধে পা কাটা পড়েছে তার। তবু সে নির্বিকার। একসময় নগরকর্তার পক্ষ থেকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাকে। কবি জানত সংবর্ধনার মাল্য জড়িয়ে না-ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে সে। কিন্তু সত্যের পক্ষে তার উচ্চারণ থামেনি।
এই অদ্ভুত নগরের সঙ্গে আউটসাইডার-এর গল্পের সম্পর্ক কী? আউটসাইডার যেভাবে গত শতাব্দীর মধ্যপর্যায়ের সময় ও সময়ের হতাশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, একইভাবে এ নাটকে দেখানো অদ্ভুত নগরও যেন এই সময়ের প্রতিবিম্ব। আর কবি—সে কি বর্তমান কালের এ-দেশীয় ম্যারসল? মিলটা যদিও একটু দূরবর্তী, তবু দুই সময়, দুই কাল যে কোনোভাবে এখানে মিলেছে একই বৃত্তে।
এতক্ষণে নিশ্চয় ঢাকা থিয়েটারের আউটসাইডার মঞ্চায়নের কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া গেল।
এখন বলি, কেমন হলো প্রযোজনাটি। বর্ণনাত্মক রীতিতে মঞ্চস্থ নাটকের পোশাক, সংগীত, আলো—সবই মানানসই। তবে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ে কোথাও যেন ছিল একটু খাদ—বর্ণনা ও সংলাপ অনেক সময়ই একাকার হয়ে গেছে, বর্ণনা থেকে সংলাপের দূরত্ব ছিল কম। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে নিজের চরিত্রের প্রতি কোনো কোনো অভিনয়শিল্পীর বিশ্বাসযোগ্যতারও অভাব ছিল হয়তো। তবে এ কথাও বলতে হবে, নাটকের এটি প্রথম মঞ্চায়ন এবং অভিনয়শিল্পীরা প্রায় সবাই নতুন। তাই সামনের প্রদর্শনীগুলোয় তাঁরা আরও ভালো করবেন—এ আশা নিশ্চয় অমূলক নয়।
নাটকের ডিজাইনটি অনন্য। নিদের্শক হিসেবে নাসির উদ্দীন ইউসুফের সাফল্য এখানেই। আর আলব্যের কামুর আউটসাইডারকে যিনি বাংলায়ন করেছেন, সেই রুবাইয়াৎ আহমেদের পারঙ্গমতা এখানে যে, নাটকটি তিনি কেবল সমকালীন করে তুলেছেন তা নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন অভিনবত্বও। সব মিলিয়ে ঢাকা থিয়েটারের নতুন প্রযোজনাটি দেখতে দেখতে আয়নায় আমরা যেন আবার নিজের মুখটি দেখতে পেলাম, এই প্রাপ্তিই বা কম কী!
 
Top