২৮ ফেব্রুয়ারি পপগুরু আজম খানের জন্মদিন। ১৯৫০ সালের এই দিনে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি মারা যান। মৃত্যুর মাস তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা কথা জানতে হঠাৎ চলে গেলাম তাঁর বাড়িতে। কমলাপুরের বাসার সিঁড়িতে আজম ভাই দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই আজম ভাই বিছানায় ডেকে বসালেন। বললেন, ‘বস, শরীরটা ভালো না, শুয়ে শুয়ে গল্প বলি শোন...।
আজম খান, azam khan
এরপর আজম ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা...তারপর স্মৃতিচারণা। মুক্তিযোদ্ধা আজম খান শুরু করলেন গান আর অস্ত্র নিয়ে তাঁর যুদ্ধের কিছু কথা...
‘একাত্তরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তো আমাদের ছাত্রজীবন। আমরা বন্ধুরা সবাই তরুণ। মিলিটারিদের জন্য তখন বাড়িতে থাকা যাচ্ছিল না। বন্ধুরা মিলে চিন্তা করলাম, মরব যখন, তখন যুদ্ধ করেই মরি। আমি আর আমার দুই বন্ধু কচি আর শফি সকালের দিকে আম্মাকে বললাম, যুদ্ধে যাব। আম্মা আব্বার অনুমতি নিতে বললেন। ভয় পেয়েছিলাম। আব্বা মনে হয় এখনই চড় মারবেন। কিন্তু না। আব্বা বললেন, “যুদ্ধে যাবি ভালো কথা যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না।” আব্বাকে সালাম করে বের হলাম দেশ স্বাধীন করতে। এরপর হাঁটতে হাঁটতে নরসিংদী, নবীনগরের ওপর দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সেই আগরতলায়। এরপর মেলাঘর ক্যাম্প। ওখান থেকে প্রশিক্ষণ নিই। সাহস বাড়ানোর জন্য আমাদের কুমিল্লা সালদা ফ্রন্টে পাঠানো হলো। আমরা গ্রামবাসীর সঙ্গে মিশে থাকতাম। গ্রামবাসীও আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। আমি ২ নম্বর সেক্টরে ছিলাম। খালেদ মোশাররফ ছিলেন আমাদের সেক্টর কমান্ডার। তখনো আমি মেলাঘর ক্যাম্পে ছিলাম। অনেকগুলো অপারেশন করেছি। একটি অপারেশনের কথা খুব মনে পড়ে। যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রেশন, গুলি—এগুলো ফুরিয়ে আসছিল। তখন আমাদের অফিসাররা বললেন, “লক্ষ রাখবেন, তাদের নতুন রেশন আসার সময় এসেছে। যদি কোনো নৌকা দেখেন, আমাকে ডাকবেন।” তখন আমি সালদা নদীর ব্রিজের নিচ দিয়ে আসছিলাম। একটি পুরান বাড়ি ছিল সামনে। সে সময় কয়েকটা নৌকা আসছিল। প্রায় ১২ থেকে ১৩টা নৌকা। ওস্তাদ বললেন, “আপনারা আগে ফায়ার করবেন না। আমি ফায়ার করলে তারপর আপনারা ফায়ার করবেন।”
‘শুরু হলো ফায়ার। নৌকাগুলো টুকরা টুকরা হয়ে গেল। পরে আমরা খবর পেলাম, ওই অপারেশনে প্রায় ৮১ জন আর্মি মারা গেছে। ওস্তাদ বললেন, “এবার পাল্টা আক্রমণ আসবে।” পাকিস্তানিরাও পরে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করে। আমরা তো তখন মাটির বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম। খালের কিনার দিয়ে সরে যাই। ঘটনাটি মনে পড়লে এখনো আমার শরীর শিউরে ওঠে। মনে হয়, যেন জানটা হাতের তালুতে ছিল।
‘বিজয় দিবসের দিন আমি বালু নদের কিনারে ছিলাম। খবর পেলাম দেশ স্বাধীন হয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকায় ঢুকি। আমরা বিজয় পেলাম। এখন ছেলেমেয়েরা দিনবদলের চেষ্টা করছে। আশা করি, একটি সোনার বাংলাদেশ হবে।
‘এর আগে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণসংগীত গাইতাম। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী থেকে। আমরা অনেকেই তখন গণসংগীত গাইতাম। এরপর তো শুরু হলো যুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানে যখনই সময় পেতাম, গানবাজনা করতাম। থালা, গ্রেনেডের বাক্স, চামচকে বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে গান গাইতাম। অন্যান্য ব্যারাকের ছেলেরা তো আসতই, ওস্তাদেরা পর্যন্ত চলে আসতেন। অনেকেই বলতেন, “কিরে, তুই এখন গান গাচ্ছিস কেন?” আমি ওদের বললাম, গান গাইলেও মরবি, না গাইলেও মরবি। মরব যখন গান গাইয়াই মরি। প্রতিদিন দুই-তিন ঘণ্টা আসর বসত। মানুষ গান শুনে কাঁদত।’
 
Top