তমালের মায়ের ভীষন চিন্তায় কাটছে দিন বেশ কিছুদিন ধরে। তমাল কেমন যেন এড়িয়ে চলছে তাকে। বাসায় সারাদিন দরজা লক করে একা থাকে ও। কারো সাথে খুব একটা কথা বলে না আর আগের মতো। কিছু জিক্ষেস করলেও হ্যা-না এর মাঝেই সীমাবদ্ধ। অথচ কিছুদিন আগেও ছেলেটা এমন ছিল না। বয়সই বা আর কত, সবে ১৩ ! এই বয়সে ওর আবার এতো কিসেরই বা প্রাইভেসী? আচ্ছা, ও কোনো সমস্যায় পড়লো না তো? কিন্তু কিসের সমস্যা এতো ছোট বয়সে? স্কুলে যাওয়া-আসা আর পড়াশুনা ছাড়া কি কাজ আছে ওর?
তমালের মায়ের মতো বাংলাদেশের হাজারও মা হয়ত তাদের সন্তানকে নিয়ে এভাবেই ভাবছেন। বয়সটা এখন ১৩। বাবা-মায়ের চোখে সন্তান এখনও ছোট। আপনি মানতে নারাজ আপনার সন্তান বড় হয়ে গেছে কিন্তু আপনি জানেন না যে এই বয়সেই শিশুর মধ্যে কী ধরনের পরিবর্ত‌ন ঘটে।
আপনার ছোট বাচ্চাটি এখন আর কোনো কিছুর জন্য বায়না ধরে জিদ করে না, সে নিজেকে সয়ংসম্পূর্ন‌ভাবে দেখতে চায়, প্রচন্ড রকম স্বাধীনচেতা হয়ে পরে সে। তার ভাবনা তখন আকাশের থেকেও বিশাল। সে ভাবতে শুরু করে কেউ তাকে বুঝতে পারছে না, পৃথিবীটা বেশ ভালোই নিষ্ঠুর। তখন সে সবার থেকেই নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখার চেষ্টা করে। এই বয়সটায় নিজেকে শিশু শুনতে যেমন ভালো লাগে না, তেমনি নিজেকে পরিনত হিসেবেও দাবি করা যায় না। সাধারনত ১৩-১৮ বছরের এ সময়টাকেই বয়ঃসন্ধিকাল বলে। এ সময়টাতে সন্তান যেমন নিজেকে খুব একা মনে করে থাকে তেমনি বাবা-মাও তাদের ছোট্ট শিশুটির হঠাৎ এ পরিবর্ত‌নকে গ্রহন করতে পারেন না। মনে হতে থাকে নিজের সন্তানটি কেমন যেন অচেনা গেছে!
কেমন হওয়া উচিত এমন সময় বাবা-মায়ের আচরন সন্তানের প্রতি?
বিভিন্ন গবেষনায় বলা হয়েছে বয়ঃসন্ধিকালের সময়ে সন্তানের সবচাইতে বেশী প্রয়োজন বন্ধুত্ব। এ সময়ে কোন বাধা-ধরা রূটিন কিংবা শাসন সন্তানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাবা মায়ের এ সময় সন্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু হওয়া প্রয়োজন। খুবই আবেগ প্রবন মন থাকে এ সময়, তাই ভুলের মাত্রাটাও বেশী হয়ে থাকে। অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে,তাকে বোঝাতে হবে কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয়। খুব অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ে মন এ সময়। বন্ধুত্বের হাতটি বাড়িয়ে তার মনের কথাগুলো শুনতে হবে,যে কথাগুলো সে হয়তো বলবে বলেও বলতে পারছে না সেই কথাগুলো শোনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
সন্তানকে বুঝিয়ে দিন আপনার প্রথম গুরুত্ব সে। বেড়িয়ে পড়ুন তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে লং ড্রাইভ কিংবা শপিংয়ে কিংবা রাতের খাবার টেবিলেও তৈরি করতে পারেন একটি গল্পময় পরিবেশ। তার কথাগুলো শোনার পর বুঝিয়ে দিন বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি গুরুত্বের সাথে কথাগুলো বিবেচনা না করেন কিংবা আপনার বোঝানোর ভাষা শাসনে পরিনত হয়, মনে রাখবেন আপনি তাকে হারিয়ে ফেলবেন সম্পূর্ণ‌ভাবে। একবার তার বিশ্বাস ভেঙে ফেললে সে আর কখনই ফিরে তাকাবে না আর আপনার দিকে। একটি বন্ধুত্বপূর্ন‌ পারিবারিক পরিবেশ অনেকাংশেই সাহায্য করে ভবিষ্যতে সুস্থ মানুষিক বিকাশে।
পড়াশোনার জন্য অধিক শাসন তার মানুষিক বিপর্য‌য়ের কারন হতে পারে। তাই পড়াশোনার বিষয়টিকে আপনি আকষর্নী‌য় করে তুলতে নিতে পারেন বিভিন্ন পদ্ধতির। সন্তানের ইচ্ছেগুলোর যথেষ্ট গুরুত্ত দিতে হবে আপনাকে। তাকে সেটাই হতে দিন যা সে পছন্দ করে, নিজের পছন্দ তার উপর জোড় করে চাপিয়ে দিতে যাবেন না। এ বয়সে নানা রকম নেগেটিভ চিন্তা সারাক্ষনই গ্রাস করে তাকে, আবেগপ্রবন হয়ে নিয়ে নিতে পারে যে কোনো ধ্বংসাত্মক সিন্ধান্ত। তাই নিজেকে ভালোবাসতে হবে, এ জিনিসটি আপনাকেই শেখাতে হবে তাকে। বুঝিয়ে দিতে হবে ওর গুরুত্ব কতখানি পৃথিবীতে।
নিজে সৎ থাকুন সন্তানের প্রতি, দেখবেন আপনার সন্তানটিও সৎ থাকবে আপনার কাছে। কোনো সমস্যায় পড়লে সে আপনাকেই প্রথম বলবে নিজ থেকে। একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, কতটুকু জানেন আপনি তার সম্পর্কে‌? ও'র ভালোলাগা, খারাপের সবকিছু জানেন তো আপনি? মাঝে মাঝেই ও'র পছন্দের জিনিস দিয়ে সারপ্রাইজ দিন ওকে। দেখবেন আপনার ছোট সেই বাচ্চাটি অচেনা নয়, বরং দিনে দিনে আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিনত হয়েছে। তাই সন্তানকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা নয়, সন্তানের বন্ধু হবার চেষ্টা করূন কারন আপনার সন্তানটি আপনার বন্ধুত্ব জন্যই অপেক্ষা করছে।
 
Top