রাইসার বাবা-মা তাকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেছেন। কিছুদিন থেকে তার মাথাব্যাথা, খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহা রয়েছে এবং কান্না করছে। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, তার শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। তাকে একজন কিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে বললেন। রাইসার বাবা-মা তো ডাক্তার সাহেবের ওপর প্রচণ্ড চটলেন। বললেন, ‘আমার মেয়ে কি পাগল যে, পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব!’ ডাক্তার আশ্বস্ত করে বললেন, না আপনার মেয়ে মোটেও পাগল নয়। তার শারীরিক সমস্যার জন্য মনোবৈজ্ঞানিক কারণ দায়ী। তাই মনোবিজ্ঞানীর কাছে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং নামক চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যবহার করে তার চিকিৎসা করতে হবে।
সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কী?
সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে কিছু টেকনিক্যাল পার্থক্য থাকলেও প্রায়োগিক দিক থেকে একই রকম। তাই আলোচনার সুবিধার্থে এ দুটোকে একই অর্থে ব্যবহার করা হলো।
সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং হলো এক ধরনের চিকিৎসামূলক পদ্ধতি। এখানে যার পেশাগত সাহায্য দরকার তাকে ‘কায়েন্ট’ (রোগী নয়) এবং যিনি সেবাটি প্রদান করেন তাকে ‘সাইকোথেরাপিস্ট’ বা ‘কাউন্সেলর’ বলে। এ পদ্ধতিতে সাইকোথেরাপিস্টের সাথে কায়েন্ট তার সমস্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় একেবারে খোলামেলাভাবে আলোচনা করেন। তবে সাইকোথেরাপিস্ট শুধু কায়েন্টই নয়, তার পরিবারের লোকজন, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তখন তিনি মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, গবেষণামূলক তথ্য ও পেশাগত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে কায়েন্টের সমস্যার বিশ্লেষণ করেন এবং কীভাবে সমস্যাটি থেকে বের হয়ে আসা যায় সে বিষয়ে কায়েন্টের সাথে আলোচনা করেন।
সাইকোথেরাপিস্ট বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে থাকেন কিন্তু সরাসরি কোনো নির্দেশনা দেন না। কোনোকিছু চাপিয়ে না দিয়ে কায়েন্টকেই তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেন। এতে কায়েন্ট তার সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। সাধারণত সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টার জন্য কায়েন্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট একসঙ্গে বসেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য নয়, বরং স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা। সুতরাং মানসিকভাবে যদি কোনো কারণে কেউ ভালো না থাকেন, তাহলে তাকে সুস্থ বলা যায় না। শরীর যেমন সামান্য কারণেই (বৃষ্টিতে ভিজে, হোঁচট খেয়ে) অসুস্থ হতে পারে, তেমনি আমাদের মনও বিভিন্ন কারণে অসুস্থ হতে পারে। শরীর ও মনের অনেক অসুখ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়, আবার অনেক অসুখ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হয়। অর্থাৎ শরীরের মতো মানুষের মনের সমস্যাগুলোরও চিকিৎসা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার যে কোনো মানুষেরই যে কোনো সময়ে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য তাকে ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করা সামাজিক অপরাধ।
কখন সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া দরকার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম ঘটনা ঘটে। নানা কারণেই আমাদের মনে বিষাদ, রাগ, দুঃখের কালো মেঘ আসতে পারে। আবার কিছুদিনের মধ্যে আমরা আবার আগের মতো চলতে থাকি। কিন্তু মনের এই কালো মেঘ যদি মাসের পর মাস চলতে থাকে এবং আমাদের লেখাপড়া-কাজকর্ম ব্যাহত হয়, তবে আমাদের মনোবিজ্ঞানীদের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। নিচের বিষয়গুলোতে সাইকোলজিস্টের সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে :
পরিকল্পনা করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হলে
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয় ও পরিকল্পনা করতে হয়। অনেক সময় আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে একজন কাউন্সেলরের সাথে কথা বললে বিষয়গুলো নিজের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কাউন্সেলর তাকে কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে তা শিখতে সাহায্য করেন।
আবেগগত সমস্যা
মনে তীব্র আবেগ জমে থাকলে তা আমাদের দৈনন্দিন কাজে অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। কারো কারো ছোটখাট বিষয়গুলোতে তীব্র দুশ্চিন্তা কাজ করে, কারো কারো বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে, অনেক সময় একই চিন্তা বা একই কাজ বাধ্যতামূলকভাবে বার বার করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি নিতে হয়।
রাগ মোকাবিলা
রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগ হলেও অনেক ক্ষেত্রে রাগ অন্যদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়, দৈনন্দিন ও পেশাগত কাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তখন তা নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ বিষয়ে দক্ষ সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নেওয়া যেতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা
বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক শারীরিক লক্ষণের জন্য মানসিক কারণ দায়ী। বাংলাদেশে এ হার আরও বেশি। প্রায়ই দেখা যায় বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি ডাক্তারের কাছে গেছে শুধু শারীরিক সমস্যা যেমন- মাথাব্যাথা, ঘুম, ব্যাথা, দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে। এছাড়া মারা যাবার ভয়, যে কোনো সময় হৃদযন্ত্র বন্ধ হবার ভয় বা স্ট্রোকের ভয় কাজ করে। অনেকে মনে করেন তার ভয়ংকর রোগ হয়েছে। ডাক্তার হার্টে বা শরীরে কোনোই সমস্যা নেই বলা সত্ত্বেও তিনি আশ্বস্ত হতে বা থাকতে পারেন না। সাইকোথেরাপি গ্রহণ করে এ সমস্ত সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
ক্রনিক স্বাস্থ্যসমস্যা
ডায়বেটিকসের মতো ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা মানুষের মধ্যে অনেক স্ট্রেস তৈরি করে। এছাড়া এসব স্বাস্থ্যসমস্যায় জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হয়। ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশেরই কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সাইকোথেরাপি (সিবিটি) এসব মানসিক সমস্যার লক্ষণ কমানোসহ ওই ক্রনিক রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
মানসিক চাপ মোকাবিলা
জীবন যত এগিয়ে যায়, মানুষকে যত ব্যস্ত থাকতে হয়, তাকে তত বেশি মাত্রার মানসিক চাপ নিতে হয়। সাধারণত মানসিক চাপগুলো আমরা নিজেরাই মোকাবিলা করতে পারি। কিন্তু এরপরও কিছু ক্ষেত্রে চাপ মোকাবিলা করতে অসুবিধা বোধ করি কিংবা এমনভাবে মোকাবিলা করি তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তখন আমরা মনোবৈজ্ঞানিক সেবা নিতে পারি।
পেশা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত
আমাদের দেশে দেখা যায় বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের ওপর নিজেদের পছন্দমতো পেশা চাপিয়ে দেন। কিন্তু ছেলে/মেয়ের কোন পেশাতে আগ্রহ বা কোন পেশা গ্রহণ করলে তার ভালো করা সম্ভাবনা আছে তা জেনে পেশা গ্রহণ করলে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত মনোবৈজ্ঞানিক টেস্ট প্রয়োগ করে মনোবিজ্ঞানী পেশা গ্রহণে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন।
মানসিকভাবে আঘাত বা দুর্ঘটনা
কোনো দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে বা দেখলে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দৃশ্যগুলো বার বার মনে আসা, ওই সব জায়গা এড়িয়ে চলা, মনে পড়লে তীব্রভাবে কষ্ট লাগা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর।
মনোযৌন সমস্যা
আমাদের দেশে যথাযথ যৌনশিক্ষা না থাকায় ও বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত থাকায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের যৌন সমস্যা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রচলিত যৌন সমস্যার বেশির ভাগই শারীরিক নয়, বরং মানসিক কারণজনিত সমস্যা। সাইকোথেরাপির মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্ক সমস্যা
জীবনের পরিক্রমায় নানা কারণে দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্কে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে নিজেরা বা গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বা গুরুজনদের সহায়তা নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নিতে হবে।
বিয়োগান্তক ঘটনা
হঠাৎ করে কেউ মারা গেলে আমাদের তীব্র কষ্টের অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘদিন তা থাকলে ও কাজকর্ম ব্যাহত হলে কাউন্সেলিং নেওয়াটা খুবই জরুরি।
আত্মহত্যার চিন্তা
আত্মহত্যার চিন্তা এলে বা কেউ আত্মহত্যা করার কথা প্রকাশ করলে তা খুবই গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে (যেমন : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট) নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি খুবই প্রয়োজনীয়।
মাদকাসক্তি
মাদকাসক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। এক্ষেত্রে কাউন্সেলর তার মনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণসহ কীভাবে এটা থেকে বের হয়ে আসা যায়, কোন কোন কারণে একজন বার বার সিøপ (রিল্যাপ্স) করেন, কীভাবে কারণগুলো রোধ করা যায়, কীভাবে চাপ ও টান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কীভাবে নতুন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় তা আলোচনা করে থাকেন।
শিশুর আচরণগত সমস্যা
শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। অতি চঞ্চলতা, মিথ্যা বলা, চুরি করা, আক্রমণাত্মক আচরণ করা, স্কুল বা বাড়ি থেকে পালানো, পড়াশোনায় অমনোযোগ, স্কুলে যেতে না চাওয়া, ভয় পাওয়া, মাকে ছেড়ে কোথাও যেতে না চাওয়া, একা একা থাকা বা সবার সাথে না খেলতে চাওয়া, সবার সাথে মিশতে না চাওয়া, চোখের দিকে না তাকানো প্রভৃতি আচরণগত সমস্যার জন্য সাইকোথেরাপি নিতে হয়।
ঘুমের সমস্যা
কোনো শারীরিক কারণ ছাড়াই ঘুমের সমস্যা হলে কাউন্সেলিং খুবই কার্যকর। মনোবিজ্ঞানী তার মানসিক কোনো কারণ আছে কিনা তা খুঁজে দেখেন। যদি মানসিক কারণ থাকে তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। না থাকলে শুধু লাইফস্টাইল ফ্যাক্টর ও বেডরুম ফ্যাক্টরগুলো পরিবর্তন করে ঘুমের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেন।
মানসিক অসুস্থতা
যে কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপি নিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ সাইকোথেরাপি পুনরায় রোগটি হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
সুতরাং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে এগিয়ে নিয়ে যেতেই প্রয়োজন কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি। তবে মনে রাখা দরকার এটা কোনো ম্যাজিক নয়, বরং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে মনোবিজ্ঞানীর সহায়তায় কায়েন্ট নিজেই নিজেকে সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে সাবধানতা হচ্ছে কাউন্সেলিং গ্রহণের আগে অবশ্যই কাউন্সেলর বা সাইকোলজিস্টের যথাযথ যোগ্যতা (একাডেমিক+প্রশিক্ষণ) সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
আপনার জীবন সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হোক।
[লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক]
সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কী?
সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে কিছু টেকনিক্যাল পার্থক্য থাকলেও প্রায়োগিক দিক থেকে একই রকম। তাই আলোচনার সুবিধার্থে এ দুটোকে একই অর্থে ব্যবহার করা হলো।
সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং হলো এক ধরনের চিকিৎসামূলক পদ্ধতি। এখানে যার পেশাগত সাহায্য দরকার তাকে ‘কায়েন্ট’ (রোগী নয়) এবং যিনি সেবাটি প্রদান করেন তাকে ‘সাইকোথেরাপিস্ট’ বা ‘কাউন্সেলর’ বলে। এ পদ্ধতিতে সাইকোথেরাপিস্টের সাথে কায়েন্ট তার সমস্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় একেবারে খোলামেলাভাবে আলোচনা করেন। তবে সাইকোথেরাপিস্ট শুধু কায়েন্টই নয়, তার পরিবারের লোকজন, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তখন তিনি মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, গবেষণামূলক তথ্য ও পেশাগত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে কায়েন্টের সমস্যার বিশ্লেষণ করেন এবং কীভাবে সমস্যাটি থেকে বের হয়ে আসা যায় সে বিষয়ে কায়েন্টের সাথে আলোচনা করেন।
সাইকোথেরাপিস্ট বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে থাকেন কিন্তু সরাসরি কোনো নির্দেশনা দেন না। কোনোকিছু চাপিয়ে না দিয়ে কায়েন্টকেই তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেন। এতে কায়েন্ট তার সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। সাধারণত সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টার জন্য কায়েন্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট একসঙ্গে বসেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য নয়, বরং স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা। সুতরাং মানসিকভাবে যদি কোনো কারণে কেউ ভালো না থাকেন, তাহলে তাকে সুস্থ বলা যায় না। শরীর যেমন সামান্য কারণেই (বৃষ্টিতে ভিজে, হোঁচট খেয়ে) অসুস্থ হতে পারে, তেমনি আমাদের মনও বিভিন্ন কারণে অসুস্থ হতে পারে। শরীর ও মনের অনেক অসুখ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়, আবার অনেক অসুখ চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হয়। অর্থাৎ শরীরের মতো মানুষের মনের সমস্যাগুলোরও চিকিৎসা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার যে কোনো মানুষেরই যে কোনো সময়ে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য তাকে ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করা সামাজিক অপরাধ।
কখন সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া দরকার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম ঘটনা ঘটে। নানা কারণেই আমাদের মনে বিষাদ, রাগ, দুঃখের কালো মেঘ আসতে পারে। আবার কিছুদিনের মধ্যে আমরা আবার আগের মতো চলতে থাকি। কিন্তু মনের এই কালো মেঘ যদি মাসের পর মাস চলতে থাকে এবং আমাদের লেখাপড়া-কাজকর্ম ব্যাহত হয়, তবে আমাদের মনোবিজ্ঞানীদের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। নিচের বিষয়গুলোতে সাইকোলজিস্টের সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে :
পরিকল্পনা করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হলে
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয় ও পরিকল্পনা করতে হয়। অনেক সময় আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে একজন কাউন্সেলরের সাথে কথা বললে বিষয়গুলো নিজের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কাউন্সেলর তাকে কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে তা শিখতে সাহায্য করেন।
আবেগগত সমস্যা
মনে তীব্র আবেগ জমে থাকলে তা আমাদের দৈনন্দিন কাজে অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। কারো কারো ছোটখাট বিষয়গুলোতে তীব্র দুশ্চিন্তা কাজ করে, কারো কারো বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে, অনেক সময় একই চিন্তা বা একই কাজ বাধ্যতামূলকভাবে বার বার করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি নিতে হয়।
রাগ মোকাবিলা
রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগ হলেও অনেক ক্ষেত্রে রাগ অন্যদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়, দৈনন্দিন ও পেশাগত কাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তখন তা নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ বিষয়ে দক্ষ সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নেওয়া যেতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা
বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক শারীরিক লক্ষণের জন্য মানসিক কারণ দায়ী। বাংলাদেশে এ হার আরও বেশি। প্রায়ই দেখা যায় বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি ডাক্তারের কাছে গেছে শুধু শারীরিক সমস্যা যেমন- মাথাব্যাথা, ঘুম, ব্যাথা, দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে। এছাড়া মারা যাবার ভয়, যে কোনো সময় হৃদযন্ত্র বন্ধ হবার ভয় বা স্ট্রোকের ভয় কাজ করে। অনেকে মনে করেন তার ভয়ংকর রোগ হয়েছে। ডাক্তার হার্টে বা শরীরে কোনোই সমস্যা নেই বলা সত্ত্বেও তিনি আশ্বস্ত হতে বা থাকতে পারেন না। সাইকোথেরাপি গ্রহণ করে এ সমস্ত সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
ক্রনিক স্বাস্থ্যসমস্যা
ডায়বেটিকসের মতো ক্রনিক স্বাস্থ্য সমস্যা মানুষের মধ্যে অনেক স্ট্রেস তৈরি করে। এছাড়া এসব স্বাস্থ্যসমস্যায় জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হয়। ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশেরই কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সাইকোথেরাপি (সিবিটি) এসব মানসিক সমস্যার লক্ষণ কমানোসহ ওই ক্রনিক রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
মানসিক চাপ মোকাবিলা
জীবন যত এগিয়ে যায়, মানুষকে যত ব্যস্ত থাকতে হয়, তাকে তত বেশি মাত্রার মানসিক চাপ নিতে হয়। সাধারণত মানসিক চাপগুলো আমরা নিজেরাই মোকাবিলা করতে পারি। কিন্তু এরপরও কিছু ক্ষেত্রে চাপ মোকাবিলা করতে অসুবিধা বোধ করি কিংবা এমনভাবে মোকাবিলা করি তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তখন আমরা মনোবৈজ্ঞানিক সেবা নিতে পারি।
পেশা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত
আমাদের দেশে দেখা যায় বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের ওপর নিজেদের পছন্দমতো পেশা চাপিয়ে দেন। কিন্তু ছেলে/মেয়ের কোন পেশাতে আগ্রহ বা কোন পেশা গ্রহণ করলে তার ভালো করা সম্ভাবনা আছে তা জেনে পেশা গ্রহণ করলে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত মনোবৈজ্ঞানিক টেস্ট প্রয়োগ করে মনোবিজ্ঞানী পেশা গ্রহণে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন।
মানসিকভাবে আঘাত বা দুর্ঘটনা
কোনো দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে বা দেখলে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দৃশ্যগুলো বার বার মনে আসা, ওই সব জায়গা এড়িয়ে চলা, মনে পড়লে তীব্রভাবে কষ্ট লাগা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর।
মনোযৌন সমস্যা
আমাদের দেশে যথাযথ যৌনশিক্ষা না থাকায় ও বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত থাকায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের যৌন সমস্যা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রচলিত যৌন সমস্যার বেশির ভাগই শারীরিক নয়, বরং মানসিক কারণজনিত সমস্যা। সাইকোথেরাপির মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্ক সমস্যা
জীবনের পরিক্রমায় নানা কারণে দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্কে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে নিজেরা বা গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বা গুরুজনদের সহায়তা নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নিতে হবে।
বিয়োগান্তক ঘটনা
হঠাৎ করে কেউ মারা গেলে আমাদের তীব্র কষ্টের অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘদিন তা থাকলে ও কাজকর্ম ব্যাহত হলে কাউন্সেলিং নেওয়াটা খুবই জরুরি।
আত্মহত্যার চিন্তা
আত্মহত্যার চিন্তা এলে বা কেউ আত্মহত্যা করার কথা প্রকাশ করলে তা খুবই গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে (যেমন : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট) নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি খুবই প্রয়োজনীয়।
মাদকাসক্তি
মাদকাসক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। এক্ষেত্রে কাউন্সেলর তার মনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণসহ কীভাবে এটা থেকে বের হয়ে আসা যায়, কোন কোন কারণে একজন বার বার সিøপ (রিল্যাপ্স) করেন, কীভাবে কারণগুলো রোধ করা যায়, কীভাবে চাপ ও টান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কীভাবে নতুন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় তা আলোচনা করে থাকেন।
শিশুর আচরণগত সমস্যা
শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। অতি চঞ্চলতা, মিথ্যা বলা, চুরি করা, আক্রমণাত্মক আচরণ করা, স্কুল বা বাড়ি থেকে পালানো, পড়াশোনায় অমনোযোগ, স্কুলে যেতে না চাওয়া, ভয় পাওয়া, মাকে ছেড়ে কোথাও যেতে না চাওয়া, একা একা থাকা বা সবার সাথে না খেলতে চাওয়া, সবার সাথে মিশতে না চাওয়া, চোখের দিকে না তাকানো প্রভৃতি আচরণগত সমস্যার জন্য সাইকোথেরাপি নিতে হয়।
ঘুমের সমস্যা
কোনো শারীরিক কারণ ছাড়াই ঘুমের সমস্যা হলে কাউন্সেলিং খুবই কার্যকর। মনোবিজ্ঞানী তার মানসিক কোনো কারণ আছে কিনা তা খুঁজে দেখেন। যদি মানসিক কারণ থাকে তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। না থাকলে শুধু লাইফস্টাইল ফ্যাক্টর ও বেডরুম ফ্যাক্টরগুলো পরিবর্তন করে ঘুমের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেন।
মানসিক অসুস্থতা
যে কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপি নিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ সাইকোথেরাপি পুনরায় রোগটি হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
সুতরাং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে এগিয়ে নিয়ে যেতেই প্রয়োজন কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি। তবে মনে রাখা দরকার এটা কোনো ম্যাজিক নয়, বরং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে মনোবিজ্ঞানীর সহায়তায় কায়েন্ট নিজেই নিজেকে সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে সাবধানতা হচ্ছে কাউন্সেলিং গ্রহণের আগে অবশ্যই কাউন্সেলর বা সাইকোলজিস্টের যথাযথ যোগ্যতা (একাডেমিক+প্রশিক্ষণ) সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
আপনার জীবন সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হোক।
[লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক]